বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৯:২৪ পূর্বাহ্ন

দলীয় অযোগ্য ভিসিদের হযবরল কাণ্ড

দলীয় অযোগ্য ভিসিদের হযবরল কাণ্ড

স্বদেশ ডেস্ক:

একটি সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসে তার মতাদর্শের পক্ষের লোকজনদের ক্ষমতায়ন করবেন, সেটা স্বাভাবিক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটবে, তেমনটা ভাবতে ভালো লাগলেও বাস্তবতা তা নয়।

সেই হিসেবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার এই দীর্ঘ সময়ে, তাদের পক্ষের শিক্ষকরা ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আগের সরকারগুলোও তাদের পক্ষের-পছন্দের শিক্ষকদেরই ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এই বাস্তবতায় এখন নতুন করে প্রশ্ন সামনে আসছে— কেন যে ‘দলীয় শিক্ষকদের ভিসি করা হয়েছে?’

কারণ কয়েকটি।

আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্তচিন্তা-মতপ্রকাশ ও রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে। ধারণাটা ছিল এমন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরাসরি রাজনীতি নয়, মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করবেন। রাজনৈতিক দলের ভুল-ত্রুটি সংশোধনে ভূমিকা রাখবেন। উন্নততর চিন্তায় রাজনীতিকদের সমৃদ্ধ করবেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সূচনা অনেকটা এমনই হওয়ার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা এমন ছিল না।

সামরিক সরকারগুলো এমন শিক্ষকদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল, যারা তাদের প্রতি অনুগত। কিন্তু সামরিক দুঃশাসনের কালেও শিক্ষকসুলক নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন ভিসির সন্ধান মিলেছে। শিক্ষার্থীদের উপর সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের নিপীড়নের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী পদত্যাগ করেছিলেন। তারপর বিএনপি সরকারের সময়ও দলীয় বিবেচনায়ই ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে৷ পূর্বের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছে।

এখনকার দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ভিসিরা যা করছেন বা তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে, পূর্বের ভিসি এমনটা করেননি বা তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠেনি কেন?

কারণ, পূর্বে ভিসি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল, তিনি প্রকৃত শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ কিনা। আওয়ামী লীগ -বিএনপি দুই দলের শিক্ষকদের মধ্যেই প্রকৃত শিক্ষক-শিক্ষাবিদ ছিলেন।

ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু দলীয় পরিচয় বিবেচিত হতো না। বিএনপি সরকার এএসএম ফায়েজকে, আওয়ামী লীগ একে আজাদ চৌধুরী বা আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে শুধু দলীয় পরিচয়ে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়নি। তারা শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে যোগ্য বিবেচনাতেই নিয়োগ পেয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তদবির করে তাদের ভিসি হতে হয়নি। ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ নেতাদের কাছেও তারা ক্ষমতা বৃদ্ধির তদ্বির করেননি। তারা নিজ দলের মতাদর্শ বাস্তবায়ন বা পারপাস সার্ভ করেছেন বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে। শিক্ষকসুলভ মানসিকতা বিকিয়ে দালালসুলভ মানসিকতা ধারণ করেননি।

এখনকার টাকা ভাগাভাগি বা নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে অভিযুক্ত ভিসিদের ভেতরে শিক্ষকসূলভ নীতি-নৈতিকতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তাদের আচরণ দলের কর্মী বা নিম্নশ্রেণির নেতার মতো। তারা ভিসি হওয়ার জন্যে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। রাজনৈতিক দলও সেই সুযোগে সবচেয়ে অযোগ্য ‘জ্বী হুজুর’ প্রবণতার শিক্ষককে ভিসি নিয়োগ দিয়েছে। এসব ভিসিকে রাজনৈতিক নেতারা যা বলেন তা তো করেনই, আগ বাড়িয়েও দৃষ্টিকটু পর্যায়ের অনেককিছু করেন।

এমন অবস্থা তৈরি হওয়ারও কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় অধ্যাপক আসিফ নজরুলের একটি লেখা থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক বছরে এত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যে, অনেক শিক্ষক টানা কয়েক মাস ক্লাস নেওয়ার সুযোগ পান না। সিনিয়র শিক্ষকদেরও প্রতিদিন একটির বেশি ক্লাস নিতে হয় না। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।

অধিক সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ একটি ভালো দৃষ্টান্ত হতে পারত, যদি শিক্ষার অগ্রগতি বিবেচনায় নিয়েই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো। ক্লাস নেওয়ার বাইরে শিক্ষকদের গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার সুযোগ ছিল। বাস্তবতা হলো, শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মেধা-যোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

মূলত ‘ভোট’ বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শিক্ষক রাজনীতির নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ার জন্যে। সেই বিজয় অর্জিত হয়েছে। তার বিনিময়ে শিক্ষা-শিক্ষকদের পরাজিত হতে হয়েছে। এসব শিক্ষক নামক ‘ভোট’ নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের তদ্বির প্রাধান্য পেয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে ভয়াবহ দুর্নীতি-অনৈতিক অভিযোগ দৃশ্যমান হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার টেলিফোন সংলাপ প্রকাশিত হয়েছে। নারীকেন্দ্রিক অনৈতিক অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন দলীয় শিক্ষক-ভিসি। শিক্ষকের সহায়তায় রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ নেত্রীরা অর্থের বিনিময়ে কর্মচারি নিয়োগে ভূমিকা রেখেছেন, প্রকাশ্য হয়েছে সেই অভিযোগ।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, হচ্ছে মূলত অর্থের বিনিময়ে। একদিকে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য-অদক্ষ-অনৈতিক-দুর্নীতিসম্পৃক্ত শিক্ষক-ভিসিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সয়লাব, অন্যদিকে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ! আজকে শিক্ষাব্যবস্থার যে করুণচিত্র দৃশ্যমান হয়েছে, আগামীতে তা আরো প্রকট হবে সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।

একটি কথা বলে শেষ করি। প্রশাসনে দল, শিক্ষায়ও দল দলীয় বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ দিলে সমস্যা ছিল না, যদি দলীয় শিক্ষকদের ভেতর থেকে যোগ্যকে বেছে নেওয়া হতো। বেছে নেওয়া হয়েছে সবচেয়ে অযোগ্যকে। অযোগ্যরা ভিসির মতো এত বড় বা গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব ধারণ করতে পারছেন না। ফলে হযবরল পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছেন। পরিণতিতে নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হচ্ছে। ডয়েচে ভেলে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877